বাসস
  ১৭ জুন ২০২৫, ১১:২৯
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫, ১১:৪০

শ্রমের বাজারে শিশুর প্রবেশ বন্ধ হোক

প্রতীকী ছবি। ইউনিসেফ বাংলাদেশ

ঢাকা, ১৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার একটি হোটেলে কাজ করে ইব্রাহিম (১১)। সকাল ৯টায় কাজে আসে, বাড়ি ফেরে রাত ১০টায়। হোটেলে সে খাবার পরিবেশন, টেবিল মোছা, বাসন-কোসন ধোয়ার কাজ করে। তিন বেলা খাবার হোটেলেই খায়। মাসে বেতন ৩ হাজার টাকা।

ঢাকার লালমাটিয়া এলাকার একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে রমিছা (১২)। তার কর্মঘণ্টা শুরু হয় সকাল ৬টায়, শেষ হয় রাত ১২টায়—যখন বাসার সবাই ঘুমাতে যায়। প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা তাকে কাজ করতে হয় তাকে।

রমিছার মতো বহু মেয়ে শিশু গৃহকর্মে নিয়োজিত। এসব শিশুকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অমানবিক পরিশ্রম করতে হয়। দিনভর খেটে অনেক শিশুই পুষ্টিকর খাবার কিংবা আরামদায়ক ঘুমানোর বিছানা পায় না। কর্মঘণ্টাও নির্ধারিত নয়। তাদের অনেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪৫ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে, যার মধ্যে ৪১ ধরনের কাজেই শিশুরা জড়িত।

শিশুশ্রম বেড়েছে। ২০১৩ সালে কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজারে। ২০১৩ সালে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমে নিয়োজিত থাকলেও এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

তবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে ১০ লাখ ৬৮ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িত, যা ২০১৩ সালে ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার।

‘শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’ অনুযায়ী দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ; কর্মজীবী শিশু ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন; শিশুশ্রমে জড়িত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। এই জরিপ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত।

বিবিএস বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই শিশু। এদের প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারে আয়ের প্রধান উৎস। দরিদ্র বাবা-মার সংসার চালাতে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিশ্রম করলেও সমপরিমাণ মজুরি পায় না। শ্রমিক হলেও শ্রমিক হিসেবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। ফলে কর্মজীবী শিশুদের দুরন্ত শৈশব ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।

হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েকে গৃহকাজে নিয়োগ দেওয়া বেআইনি। ২০১৫ সালে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা’ প্রণীত হলেও তা এখনও আইনে পরিণত হয়নি।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, রাজধানীর বাসাগুলোতে কারা থাকে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় গৃহশ্রমিক শিশুরা অনাচারের শিকার হলেও বিচার হয় না।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সমন্বয়কারী সাফিয়া সামি বলেন, গৃহ শ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা জরুরি। উন্নয়নকর্মীদের মতো সরকারি কর্মচারীদেরও ঘোষণা দিতে হবে—তারা বাসায় শিশু শ্রমিক রাখবেন না। তাহলেই নির্যাতনের হার কমবে।

তিনি বলেন, আমাদের গবেষণা বলছে—গৃহশ্রমিক শিশুরা যৌন হয়রানিসহ নানা নিপীড়নের শিকার হয়।

২০২৩ সালে শ্রম আইন সংশোধন হলেও তাতে গৃহশ্রমিকদের কথা নেই। ফলে তারা শ্রমিক হিসেবে কোনো সুবিধা পায় না। অন্যান্য শ্রমে কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হলেও গৃহকর্মে নেই। শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অভিযোগও করা যায় না। এসব শিশু শিক্ষার সুযোগ কিংবা অবসর সময়েও বঞ্চিত।

‘অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট’ (এএসডি) পরিচালিত ‘সিচুয়েশন অব চাইল্ড ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীতে গৃহ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার, ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকে।

জরিপে অংশ নেয় ৩৫২ জন শিশু, যাদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ শারীরিক আঘাত, ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ মারধর, ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ বকাঝকা এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা যায়, গৃহকর্মীদের ৬৭ শতাংশ মানসিক, ৬১ শতাংশ মৌখিক ও ২১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ঘটে মৃত্যুও।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ বছর বয়সী প্রীতি উরাং নামের গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা আলোচনায় আসে। ছয় মাস আগে একই বাসা থেকে পালিয়ে আহত হয় ৯ বছরের ফেরদৌসী। মামলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ফেরদৌসীর চিকিৎসা ও ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ছাড়া পান। ফেরদৌসী এখনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না।

করোনা মহামারিতে শিশুশ্রম আরও বেড়েছে। আইএলওর জরিপ বলছে, বিশ্বে প্রায় ৩৬ কোটি ৬০ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে। প্রতি ছয় শিশুর একজন শ্রমে যুক্ত। পাচার, সন্ত্রাস ও নির্যাতনে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ২২ হাজার শিশু।

শ্রম অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে শিশুশ্রমিক রয়েছে ৬৯ লাখ। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে শিশু সংখ্যা ছয় কোটির বেশি। ৯০ শতাংশ স্কুলে ভর্তি হলেও অর্ধেকই ঝরে পড়ে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরিপ বলছে, ৫৭ শতাংশ শিশু শুধু খাদ্যের বিনিময়ে শ্রম দেয়। ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু মজুরি পেলেও তা অতি সামান্য।

আইএলও ও ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, শহরে শিশুরা প্রায় ৩০০ ধরনের কাজে নিয়োজিত। ৭০৯টি কারখানায় ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ জনই শিশু।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে এক লাখ শিশুকে ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চার মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাসে এক হাজার টাকা করে উপবৃত্তিও দেওয়া হবে বিকাশের মাধ্যমে।

এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল এবং ২০৪১ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গঠনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’-এর ১২তম সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হয়। গ্রামে ইটভাটাসহ বিভিন্ন সেক্টরে শিশু শ্রম বেশি।

তিনি বলেন, 'শিশুশ্রম শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।' আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুযায়ী শিশুশ্রম বন্ধে বাংলাদেশ কাজ করছে বলেও তিনি জানান।

এএসডির নির্বাহী কমিটির সভাপতি ড. আলতাফ হোসেন বলেন, দেশে শিশু সুরক্ষায় নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন না হলে তা অর্থহীন। শিশু নির্যাতনের প্রকৃত পরিসংখ্যান আমাদের নেই। ঘটনা আলোচনায় এলে বা গণমাধ্যমে এলে কেবল জানাজানি হয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। মালিকরা আইনের তোয়াক্কা না করে শিশুদের দিয়ে কম বেতনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাচ্ছে।

এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে ‘জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৫’ গ্রহণ করা হয়েছে। পথশিশুদের পুনর্বাসন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের উন্নয়ন কর্মসূচিও চলছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ও আইএলও কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে।